১৮৮০ সালের দিকে সমগ্র বাংলাদেশে কৃষি প্রদর্শনীর জোয়ার এসেছিল। বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলা সদরে, মহকুমায় ও বড় বড় শহরে এমনি প্রদর্শনী (কৃষি) অনুষ্ঠিত হয়। এর সাথে ছিল সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। ১৮২২ সালে জামালপুরের ততকালীন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু নন্দকৃষ্ণ বসু, আইসিএস অনুরূপ একটি কৃষি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যায় কিনা সে বিষয়ে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সুধীজনদের নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন- শ্রী ঈশ্বর চন্দ্র গুহ, বাবু দ্বারকানাথ সেন, বাবু মহিম চন্দ্র ঘোষ, বাবু হরিষ চন্দ্র গুহ অন্যতম। মেলা পরিচালনার জন্য মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট এন.কে বোসকে সভাপতি করে আরও ১৪ জন সদস্য নিয়ে জামালপুর পাবলিক মেলা নামে একটি প্রদর্শনী মেলার পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে জমিদার ও উকিলদের প্রতিনিধি থাকেন ৮ জন এবং অন্য ৬ জন থাকেন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীবৃন্দ। প্রাথমিক ব্যয় নির্বাহের জন্য স্থানীয় জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য অর্থশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে মেলার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। মেলা বা কৃষি প্রদর্শনীর জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় জামালপুরের বর্তমান স্টেডিয়াম মাঠকে। প্রদর্শনীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর জামালপুর জেলায় উপার্জিত বিভিন্ন প্রকার ফসলের প্রদর্শনী এবং জনগণের খরিদের ফসলের বিভিন্ন প্রকার পণ্য সম্ভারের দোকান। প্রাথমিক পর্যায়ে অস্থায়ী ভাবে প্রদর্শনীর জন্যে বিভিন্ন স্টল তৈরি করে প্রতি বছর প্রদর্শনী শুরু হয়। পরবর্তীকালে যখন কমিটি দেখল, এই মেলা লাভজনক হিসেবে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন তারা মেলার জন্য স্থায়ী টিনের ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর স্থায়ী আবাস নির্মাণ করেন। বর্তমান জামালপুর স্টেডিয়াম মাঠের সমগ্র অঞ্চল জুড়ে কৃষি ও শিল্প পণ্যের বিভিন্ন স্টল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রঙ্গমঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। স্টেডিয়ামের উত্তর পার্শ্বে যেখানে বর্তমান জামালপুর জিলা স্কুলের ছাত্রাবাস, এ অংশে যাত্রা ও সার্কাসের জন্য স্থান নির্ধারিত ছিল। জামালপুরের এই মেলার বা প্রদর্শনীর খবর দ্রুত গতিতে সমগ্র পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। মেলার আয়ের প্রধান উতস ছিল গবাদি পশু বিক্রির ছাড়পত্র। বর্তমান জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সংলগ্ন জামালপুর থানার এলাকা জুড়ে মেলায় আগত সমস্ত গবাদি পশুর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ ছাড়াও মেলায় আগত লোকজনদের পানীয় জলের অভাব পূরণের জন্য মেলা কমিটি অনেক গুলো বড় বড় ইঁদারা তৈরি করেন। জামালপুর পাবলিক মেলার স্মৃতির স্বাক্ষর হিসেবে জামালপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন আনসার অফিস কটি ও জামালপুর থানার সামনে অব্যবহৃত ইঁদারাটি এখনো রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯০৭ সালের দিকে গবাদি পশু বেচা-কেনার জন্য গৌরীপুর কাছারী সংলগ্ন মাঠ ব্যবহৃত হতো। সেই সময় মেলাকে সরকারী সম্পদ করার জন্য দুরভিসন্ধি শুরু হয়। জনহিতকর কাজের একমাত্র আর্থিক উতস কেন্দ্রকে সরকারী সম্পত্তি করার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় জনসাধারণ। কিছুতেই এ মেলাকে সরকারের হাতে তুলে দেয়া হবে না। বিরোধ বেধে ছিল প্রশাসনিক মতার সাথে। কিন্তু কিছুতেই এ বিরোধ নিস্পত্তি হয়নি। জনগণকে আশ্রয় নিতে হয় বিচারালয়ে ১৮৮৭ সালে। মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের বিচারে এ মেলা জনসাধারণের সম্পত্তি বলে সাব্যস্ত হয়। মেলা পরিচালনার জন্য ১৫ জন সদস্যের মধ্যে চার জন ম্যাজিস্ট্রেট ও জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট, চার জন উকিল, চার জন মোক্তার, তিন জন জমিদার নিয়ে মেলার স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়েছিল। বাংলার পূর্বাঞ্চলের জেলা সমূহ হতে কৃষকরা আসতেন এই মেলায় তাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী খরিদ করতে। প্রতি বছর শীতের শেষে এই মেলা আরম্ভ হত এবং প্রায় ৪ মাস কাল এ মেলা চলত। পরবর্তীকালে মেলাটি অত্র অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মেলায় রূপান্তরিত হয়। জামালপুরের সেই পাবলিক মেলা আজ নেই কিন্তু সেই মেলার বা প্রদর্শনীর স্মৃতি আজও বয়ো-বৃদ্ধ জনের হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে।