গৌরবময় ইতিহাস, প্রাচীনতম লোকজ ঐতিহ্য, সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারার সমন্বয়ে গঠিত এক সমৃদ্ধ জনপদ এই জামালপুর জেলা। এই জনপদবাসীর জীবন ও জীবিকার স্বরূপ ও মানস সংস্কৃতির পরিচয় আদিকাল হতে বিধৃত হয়েছে বিবিধ গীতিকায়, সাহিত্যে ও ইতিহাসে। জামালপুরের লোক সংস্কৃতিতে যেটুকু স্বতন্ত্র, তার উৎস হচ্ছে- এ জেলার পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য, জীবন প্রবাহ আর গৌঁরবময় বিদ্রোহের ঐতিহ্য প্রসূত। এই যুক্তিগুলি প্রতীয়মান হয়- যখন এ অঞ্চলে ঘাটু, থুবো, বারমাইস্যা ইত্যাদি লোকায়িত সঙ্গীতে বৃটিশদের নিপীড়ন-নির্যাতন এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উপাদান, দারিদ্র্যের কারণে আসাম চলে যাবার কথা ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের লোকগীতিকা মহুয়া-মলুয়ার সুরের প্রভাব জামালপুরের লোক সংগীতে ব্যাপক ভাবে উপলব্ধি হয়। যেমন জামালপুরের বিয়ের গীত, খায়রনের পালা এমনকি এ অঞ্চলের শিল্পীদের কণ্ঠের বিভিন্ন গানে ময়মনসিংহ গীতিকার সুরের স্পষ্ট প্রভাব পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে কেবলই বাণী ভিন্ন, কিন্তু সুর হুবহু মলুয়ার। এখানকার জারি, সারী, থুবো, ঘাটু প্রভৃতি গানেও ময়মনসিংহ গীতিকার প্রভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাণীরও মিল রয়েছে। জামালপুরের সাথে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম না হওয়ায় বাণিজ্যিক, বৈবাহিক এবং অন্যবিধ অনেক কারণে অন্যস্থানের সাথে জামালপুরের লোক সমাজের নিবিড় সম্পর্ক বহু প্রাচীনকালের। এককালে জামালপুরের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের জলপথে আসামের সাথে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। ফলে জামালপুরের লোক সংস্কৃতিতে আসাম অঞ্চলেরও প্রভাব লণীয়। এসব প্রভাব ধীরে ধীরে পরিমার্জিত হয়ে পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতি ভিন্ন একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে। আর এটা ঘটেছে লোক সংস্কৃতির নিরন্তর রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। কারণ এই অঞ্চলের সুদূর অতীত কালের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিষয়ে কোন নির্ভরযোগ্য ইতিহাস সহজলভ্য নয়। এ অঞ্চলের মানুষের বসবাস কত প্রাচীন, ভূ-খন্ডটির উদ্ভবকাল কখন, এখানে সভ্যতার বিকাশ কিভাবে ঘটেছে এর পূর্ণ বিবরণ আজো প্রণীত হয়নি। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বৃহৎ প্রবাহ এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে একই ভাবে। এখানকার মানুষের ধর্ম, আচার-বিশ্বাস, লোকাচার পরিণত হয়েছে লোক সংস্কৃতিতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুণেই। এলাকার লোক সঙ্গীত ও লোকশিল্পে তার ছাপ পড়েছে আপন উচ্চারণের মধ্য দিয়েই। ুদ্রায়তন জামালপুর জেলার লোক ভাষারও একটা মিশ্র চরিত্র লণীয়। আবহমানকালের লোক সংস্কৃতির এই ধারায় জামালপুর বিপুল সম্ভাবনাময়। ক্রমশঃ নাগরিক আয়োজনে তা হারিয়ে যাচ্ছে। বিকাশমান সংস্কৃতির অনিবার্য নিয়মেই ঘটনাটি নিরবে ঘটে যাচ্ছে। তবে মানুষের শাশ্বত বিকাশের ধারাকে আবিষ্কার করে আগামী সংস্কৃতিকে আরও সম্ভাবনাময় করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আর এই বিপুল লোক সাংস্কৃতিক সম্ভাবনার মধ্যে যতটুকু বিকাশ সম্ভব ততটুকু ইতিহাস চেতনাকে বিবেচনায় রেখে তা বিকাশের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।