ঐতিহ্য-নকশিকাঁথা

ঢাকায় যে বাহারি নকশিকাঁথা পাওয়া যায় তার সবটাই প্রায় জামালপুরের তৈরি। তাতে যে মায়াবী স্পর্শ লেগে আছে জামালপুরের তরুণী-মহিলাদের-একথা অনেকেই জানেন না। একথাও অনেকে জানেন না- এই নকশিকাঁথা তৈরি করতে এসব নিপুণ শিল্পীদের যে শ্রম দিতে হয় তারা তার ন্যায্যমূল্য পান না। একসময় এই জামালপুর জেলার মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এখন মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ, অবহেলিত দেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ এই জেলার মহিলারা বেছে নিয়েছেন নিজেদের আত্মকর্মসংস্থানের পথ। নকশিকাঁথা ও সূচিকর্ম শিল্পের মাধ্যমে নিজেরাই শুধু স্বাবলম্বী হচ্ছেন না, তারা দেশে-বিদেশে এক বৈপ্লবিক ধারার সূচনা করেছেন। এর ফলে জেলার দারিদ্র্য বিমোচনে খুলে গেছে এক নতুন মাত্রার সম্ভাবনার দ্বার। মহিলাদের এই অর্থকরী কর্মকান্ড অনেকের পরিবারে বয়ে এনেছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, হাসি-আনন্দ। এই জেলায় চলছে সূচিশিল্প নকশিকাঁথা তৈরির এক বিরাট কর্মপ্রবাহ। এই অঞ্চলে কর্ম দক্ষ মহিলা উদ্যোক্তারা জেলায় গড়ে তুলেছেন শতাধিক ছোট-বড় সূচিশিল্প প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হল শতদল, রওজা, সূচিকা, সৌখিন হস্তশিল্প, রংধনু জীবিকা, কারুপল্লী, ক্যাম্প, প্রত্যয় ক্র্যাফট, প্রতীক শিল্প, সৃজন, তরঙ্গ তিরুথা বিত্তহীন মহিলা সমিতি, কারুনীড়, কারুনিলয়, স্বর্ণালী, লোকজ সাজ, স্বদেশ হস্তশিল্প, গ্রামীণ সাজ, দীপ্ত কুটির, নকশি, রুনা কুটির, ঝিনুক ও উপার্জন হস্তশিল্প। এছাড়া ব্র্যাক পরিচালিত শহরে আয়শা আবেদ ফাউন্ডেশনও রয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই পেশায় জড়িয়ে রয়েছেন অনেক মহিলা। এদের মধ্যে অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ব্যবসায় সফলতা লাভ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে জেলার প্রায় বিশ হাজারেরও অধিক গ্রামীণ দরিদ্র মহিলা কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। সূচিশিল্প ও সেলাই কাজে মহিলাদের নরম হাতের মানসম্পন্ন কাজের নকশিকাঁথা, পাঞ্জাবী, মেয়েদের বেড কভার, বটুয়া, হ্যান্ড পার্স, কয়েন পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগসহ নানা ধরনের দ্রব্যের দেশে-বিদেশে প্রচুর কদর রয়েছে।
কাজের ধারা : প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মহিলারা এককভাবে অথবা দলবদ্ধভাবে এই সূচিকর্ম করে থাকেন। কখনো প্রতিষ্ঠানে বসেই বা নিজ নিজ বাড়িতে সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে এই সেলাইয়ের কাজ করেন। মহিলারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প থেকে নকশিকাঁথা ও সূচিকর্মের এবং অন্যান্য কাজের কাপড়ের ওপর ট্রেসিং পেপারে অংকিত নকশা বসিয়ে রঙের ছাপ দিয়ে নিয়ে তার উপর নানা রঙের সুতা দিয়ে সেলাই সম্পন্ন করেন।
মালামাল, শ্রম ও মজুরি : ৬ হাত দৈর্ঘ্য এবং ৫ হাত প্রস্থ একটি নকশিকাঁথা প্রস্তুত করতে ১২ গজ কাপড় লাগে। সাদা কাঁথার জন্য মার্কিন অফ হোয়াইট এবং রঙিন কাঁথার জন্য থাই কটন কাপড় ব্যবহার করা হয়। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে করলে একটি কাঁথা তৈরি করতে চার জন মহিলার পঁচিশ থেকে ত্রিশ দিন সময় লাগে। একটানা কাজ করলে দশ থেকে পনের দিনে একটি কাঁথা শেষ করা যায়। প্রতি কাঁথায় শ্রমজীবী মহিলারা মজুরি পান ৮৫০ থেকে ১২০০ টাকা। একটি কাঁথা প্রস্তুত করতে মোট খরচ হয় ১৪০০ থেকে ১৮৫০ টাকা। একইভাবে একটি নকশি পাঞ্জাবি একজন মহিলা দুই থেকে পাঁচ দিনে শেষ করতে পারেন। এর জন্য প্রকারভেদে ৩০ থেকে ৬০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। কাপড়, সেলাই ও নকশাসহ একটি সুতি পাঞ্জাবি তৈরি করতে ২৫০ টাকা, চেক পাঞ্জারি ২৭০ টাকা এবং সিল্ক পাঞ্জাবি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা ব্যয় হয়।
বিপণন : জামালপুরের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শো-রুম ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে হস্তশিল্পের আকর্ষণীয় শো-রুমগুলো থেকে জামালপুরের এসব নকশিকাঁথা ও সূচিকর্ম বিক্রি হয়। এছাড়া আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশে জামালপুরের হস্তশিল্পের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। জামালপুরের স্থানীয় উদ্যোক্তারা একটি নকশিকাঁথা দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন। বিদেশে এর মূল্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সুতি ও চেক পাঞ্জাবি ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা এবং সিল্ক পাঞ্জাবি ৭৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হলেও সৌদি আরবে এই পাঞ্জাবি ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ৩৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ২৬ ইঞ্চি প্রস্থ একটি ওয়ালমেট প্রস্তুত করতে খরচ হয় ২৫৫ থেকে ২৬০ টাকা। এগুলো দেশে বিক্রি হয় ২৯০ থেকে ৩১০ টাকা এবং বিদেশে প্রতিটি বিক্রি হয় ২ হাজার টাকায়। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণের অসুবিধার কারণে উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ।
সরকারিভাবে জামালপুরের এই সম্ভাবনাময় নকশিকাঁথা ও সূচিকর্ম শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার হাত যদি বাড়ানো যায় তাহলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে গোটা জেলার ভাগ্যবঞ্চিত মানুষ। দারিদ্র্য বিমোচনসহ জামালপুরবাসীর জন্য এই শিল্প উন্মোচিত করতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।