ঐতিহ্য-নকশিকাঁথা

ঢাকায় যে বাহারি নকশিকাঁথা পাওয়া যায় তার সবটাই প্রায় জামালপুরের তৈরি। তাতে যে মায়াবী স্পর্শ লেগে আছে জামালপুরের তরুণী-মহিলাদের-একথা অনেকেই জানেন না। একথাও অনেকে জানেন না- এই নকশিকাঁথা তৈরি করতে এসব নিপুণ শিল্পীদের যে শ্রম দিতে হয় তারা তার ন্যায্যমূল্য পান না। একসময় এই জামালপুর জেলার মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এখন মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ, অবহেলিত দেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ এই জেলার মহিলারা বেছে নিয়েছেন নিজেদের আত্মকর্মসংস্থানের পথ। নকশিকাঁথা ও সূচিকর্ম শিল্পের মাধ্যমে নিজেরাই শুধু স্বাবলম্বী হচ্ছেন না, তারা দেশে-বিদেশে এক বৈপ্লবিক ধারার সূচনা করেছেন। এর ফলে জেলার দারিদ্র্য বিমোচনে খুলে গেছে এক নতুন মাত্রার সম্ভাবনার দ্বার। মহিলাদের এই অর্থকরী কর্মকান্ড অনেকের পরিবারে বয়ে এনেছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, হাসি-আনন্দ। এই জেলায় চলছে সূচিশিল্প নকশিকাঁথা তৈরির এক বিরাট কর্মপ্রবাহ। এই অঞ্চলে কর্ম দক্ষ মহিলা উদ্যোক্তারা জেলায় গড়ে তুলেছেন শতাধিক ছোট-বড় সূচিশিল্প প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হল শতদল, রওজা, সূচিকা, সৌখিন হস্তশিল্প, রংধনু জীবিকা, কারুপল্লী, ক্যাম্প, প্রত্যয় ক্র্যাফট, প্রতীক শিল্প, সৃজন, তরঙ্গ তিরুথা বিত্তহীন মহিলা সমিতি, কারুনীড়, কারুনিলয়, স্বর্ণালী, লোকজ সাজ, স্বদেশ হস্তশিল্প, গ্রামীণ সাজ, দীপ্ত কুটির, নকশি, রুনা কুটির, ঝিনুক ও উপার্জন হস্তশিল্প। এছাড়া ব্র্যাক পরিচালিত শহরে আয়শা আবেদ ফাউন্ডেশনও রয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই পেশায় জড়িয়ে রয়েছেন অনেক মহিলা। এদের মধ্যে অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ব্যবসায় সফলতা লাভ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে জেলার প্রায় বিশ হাজারেরও অধিক গ্রামীণ দরিদ্র মহিলা কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। সূচিশিল্প ও সেলাই কাজে মহিলাদের নরম হাতের মানসম্পন্ন কাজের নকশিকাঁথা, পাঞ্জাবী, মেয়েদের বেড কভার, বটুয়া, হ্যান্ড পার্স, কয়েন পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগসহ নানা ধরনের দ্রব্যের দেশে-বিদেশে প্রচুর কদর রয়েছে।
কাজের ধারা : প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মহিলারা এককভাবে অথবা দলবদ্ধভাবে এই সূচিকর্ম করে থাকেন। কখনো প্রতিষ্ঠানে বসেই বা নিজ নিজ বাড়িতে সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে এই সেলাইয়ের কাজ করেন। মহিলারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প থেকে নকশিকাঁথা ও সূচিকর্মের এবং অন্যান্য কাজের কাপড়ের ওপর ট্রেসিং পেপারে অংকিত নকশা বসিয়ে রঙের ছাপ দিয়ে নিয়ে তার উপর নানা রঙের সুতা দিয়ে সেলাই সম্পন্ন করেন।
মালামাল, শ্রম ও মজুরি : ৬ হাত দৈর্ঘ্য এবং ৫ হাত প্রস্থ একটি নকশিকাঁথা প্রস্তুত করতে ১২ গজ কাপড় লাগে। সাদা কাঁথার জন্য মার্কিন অফ হোয়াইট এবং রঙিন কাঁথার জন্য থাই কটন কাপড় ব্যবহার করা হয়। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে করলে একটি কাঁথা তৈরি করতে চার জন মহিলার পঁচিশ থেকে ত্রিশ দিন সময় লাগে। একটানা কাজ করলে দশ থেকে পনের দিনে একটি কাঁথা শেষ করা যায়। প্রতি কাঁথায় শ্রমজীবী মহিলারা মজুরি পান ৮৫০ থেকে ১২০০ টাকা। একটি কাঁথা প্রস্তুত করতে মোট খরচ হয় ১৪০০ থেকে ১৮৫০ টাকা। একইভাবে একটি নকশি পাঞ্জাবি একজন মহিলা দুই থেকে পাঁচ দিনে শেষ করতে পারেন। এর জন্য প্রকারভেদে ৩০ থেকে ৬০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। কাপড়, সেলাই ও নকশাসহ একটি সুতি পাঞ্জাবি তৈরি করতে ২৫০ টাকা, চেক পাঞ্জারি ২৭০ টাকা এবং সিল্ক পাঞ্জাবি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা ব্যয় হয়।
বিপণন : জামালপুরের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শো-রুম ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে হস্তশিল্পের আকর্ষণীয় শো-রুমগুলো থেকে জামালপুরের এসব নকশিকাঁথা ও সূচিকর্ম বিক্রি হয়। এছাড়া আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশে জামালপুরের হস্তশিল্পের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। জামালপুরের স্থানীয় উদ্যোক্তারা একটি নকশিকাঁথা দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন। বিদেশে এর মূল্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সুতি ও চেক পাঞ্জাবি ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা এবং সিল্ক পাঞ্জাবি ৭৫০ টাকা থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হলেও সৌদি আরবে এই পাঞ্জাবি ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ৩৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ২৬ ইঞ্চি প্রস্থ একটি ওয়ালমেট প্রস্তুত করতে খরচ হয় ২৫৫ থেকে ২৬০ টাকা। এগুলো দেশে বিক্রি হয় ২৯০ থেকে ৩১০ টাকা এবং বিদেশে প্রতিটি বিক্রি হয় ২ হাজার টাকায়। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণের অসুবিধার কারণে উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ।
সরকারিভাবে জামালপুরের এই সম্ভাবনাময় নকশিকাঁথা ও সূচিকর্ম শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সহযোগিতার হাত যদি বাড়ানো যায় তাহলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে গোটা জেলার ভাগ্যবঞ্চিত মানুষ। দারিদ্র্য বিমোচনসহ জামালপুরবাসীর জন্য এই শিল্প উন্মোচিত করতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

সাংস্কৃতিকধারা

শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে জামালপুর জেলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। অনেক বরেণ্য ব্যক্তির জন্ম হয়েছে এই জেলায়। খ্যাতিমান এ সকল ব্যক্তিরা দেশে ও বিদেশে এই জেলার সুনাম বয়ে এনেছেন। শ্রদ্ধাভরে যাদের কথা স্মরণ করা যায় তাদের মধ্যে রয়েছেন, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, ওস্তাদ ফজলুল হক, গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, বিশিষ্ট অভিনেতা-চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, আনোয়ার হোসেন, আব্দুলাহ আল মামুন প্রমুখ। ভারতীয় বাংলা সিনেমার নায়ক রঞ্জিত মল্লিকের বাড়িও এই জামালপুরে। শহরের প্রেসকাবের সামনে ছিল তার বাড়ি। বাড়িটি আগে মল্লিক বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। ভারতের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী গণেশ হালুই এবং ভারতের দিল্লী আর্ট কাউন্সিলের অধ্য ডঃ নীরেন সেন গুপ্তের বাড়িও ছিল এই শহরেই। জামালপুর জেলা বর্তমানে সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান হিসেবে এক অভূতপূর্ব সারা জাগিয়েছে। বিশেষ করে এনটিভির কোজআপ-ওয়ান তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের কোজআপ-ওয়ান বিজয়ী নোলক বাবু ও প্রথম রানার আপ রাজীবের বাড়ি এই জামালপুর শহরে। জাতীয় শিা সপ্তাহ, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা, নতুন কুঁড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যে সকল উদীয়মান শিল্পী প্রতিভার স্বার রাখছে আলিফ লায়লা মৌসুমী, ভুলনা খাতুন, অবন্তী দেব সিঁথি, মাসুম রহমান, সাফিয়া আফরোজ ইথি, দিপ্তী, পুতুল সেন, প্রয়াত নিপা সাহাসহ বেশ কিছু নবীন ও শিশু শিল্পী। এছাড়া বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে তালিকাভূক্ত অনেক শিল্পী রয়েছেন জামালপুরের। জামালপুর জেলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও নাট্যগোষ্ঠী রয়েছে। সঙ্গীত বিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে কলতান কচি-কাঁচার মেলা, মণিমেলা খেলাঘর আসর, লোকজ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা, গুরুমুখী সঙ্গীত বিদ্যালয় এবং জামালপুর সঙ্গীত বিদ্যালয়। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অগ্রসর এই জেলায় দীর্ঘদিন ধরে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছেন এই জেলাবাসী।

লোক-সংস্কৃতি

গৌরবময় ইতিহাস, প্রাচীনতম লোকজ ঐতিহ্য, সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারার সমন্বয়ে গঠিত এক সমৃদ্ধ জনপদ এই জামালপুর জেলা। এই জনপদবাসীর জীবন ও জীবিকার স্বরূপ ও মানস সংস্কৃতির পরিচয় আদিকাল হতে বিধৃত হয়েছে বিবিধ গীতিকায়, সাহিত্যে ও ইতিহাসে। জামালপুরের লোক সংস্কৃতিতে যেটুকু স্বতন্ত্র, তার উৎস হচ্ছে- এ জেলার পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য, জীবন প্রবাহ আর গৌঁরবময় বিদ্রোহের ঐতিহ্য প্রসূত। এই যুক্তিগুলি প্রতীয়মান হয়- যখন এ অঞ্চলে ঘাটু, থুবো, বারমাইস্যা ইত্যাদি লোকায়িত সঙ্গীতে বৃটিশদের নিপীড়ন-নির্যাতন এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উপাদান, দারিদ্র্যের কারণে আসাম চলে যাবার কথা ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের লোকগীতিকা মহুয়া-মলুয়ার সুরের প্রভাব জামালপুরের লোক সংগীতে ব্যাপক ভাবে উপলব্ধি হয়। যেমন জামালপুরের বিয়ের গীত, খায়রনের পালা এমনকি এ অঞ্চলের শিল্পীদের কণ্ঠের বিভিন্ন গানে ময়মনসিংহ গীতিকার সুরের স্পষ্ট প্রভাব পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে কেবলই বাণী ভিন্ন, কিন্তু সুর হুবহু মলুয়ার। এখানকার জারি, সারী, থুবো, ঘাটু প্রভৃতি গানেও ময়মনসিংহ গীতিকার প্রভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাণীরও মিল রয়েছে। জামালপুরের সাথে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম না হওয়ায় বাণিজ্যিক, বৈবাহিক এবং অন্যবিধ অনেক কারণে অন্যস্থানের সাথে জামালপুরের লোক সমাজের নিবিড় সম্পর্ক বহু প্রাচীনকালের। এককালে জামালপুরের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের জলপথে আসামের সাথে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। ফলে জামালপুরের লোক সংস্কৃতিতে আসাম অঞ্চলেরও প্রভাব লণীয়। এসব প্রভাব ধীরে ধীরে পরিমার্জিত হয়ে পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতি ভিন্ন একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে। আর এটা ঘটেছে লোক সংস্কৃতির নিরন্তর রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। কারণ এই অঞ্চলের সুদূর অতীত কালের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিষয়ে কোন নির্ভরযোগ্য ইতিহাস সহজলভ্য নয়। এ অঞ্চলের মানুষের বসবাস কত প্রাচীন, ভূ-খন্ডটির উদ্ভবকাল কখন, এখানে সভ্যতার বিকাশ কিভাবে ঘটেছে এর পূর্ণ বিবরণ আজো প্রণীত হয়নি। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বৃহৎ প্রবাহ এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে একই ভাবে। এখানকার মানুষের ধর্ম, আচার-বিশ্বাস, লোকাচার পরিণত হয়েছে লোক সংস্কৃতিতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুণেই। এলাকার লোক সঙ্গীত ও লোকশিল্পে তার ছাপ পড়েছে আপন উচ্চারণের মধ্য দিয়েই। ুদ্রায়তন জামালপুর জেলার লোক ভাষারও একটা মিশ্র চরিত্র লণীয়। আবহমানকালের লোক সংস্কৃতির এই ধারায় জামালপুর বিপুল সম্ভাবনাময়। ক্রমশঃ নাগরিক আয়োজনে তা হারিয়ে যাচ্ছে। বিকাশমান সংস্কৃতির অনিবার্য নিয়মেই ঘটনাটি নিরবে ঘটে যাচ্ছে। তবে মানুষের শাশ্বত বিকাশের ধারাকে আবিষ্কার করে আগামী সংস্কৃতিকে আরও সম্ভাবনাময় করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আর এই বিপুল লোক সাংস্কৃতিক সম্ভাবনার মধ্যে যতটুকু বিকাশ সম্ভব ততটুকু ইতিহাস চেতনাকে বিবেচনায় রেখে তা বিকাশের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

সাহিত্য-সংস্কৃতি

জামালপুরের বুক চিরে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের পলিমাটি শুধু কৃষি ভূমিকে উর্বর করে সোনার ফসলই দান করেনি। পলিবিধৌত জামালপুরের মাটিতে জন্ম নিয়েছেন অনেক গুণী-জ্ঞাণী ব্যক্তি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চারুকলাবিদ, ক্রীড়াবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী প্রমুখ। সুদূর অতীত কাল থেকে দীর্ঘদিনের ঐকান্তিক সাধনায় শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এইসব সাহিত্য সংস্কৃতি সাধকেরা তাদের আপন মনের মাধুরী দিয়ে রচনা করে দিয়ে গেছেন বিভিন্ন সাহিত্য-শিল্প। অতীতের সেই সব সাহিত্যিক শিল্পীরা সমাজ জীবনের বিচিত্র চিত্র-রূপায়নের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতির কর্মসাধনের পথ রচনা করে দিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে এখনো রয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুন, চিত্রশিল্পী বীরেন সোম এর নাম উল্লেখযোগ্য। জামালপুরে অতীতের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে স্বাভাবিক কারণেই প্রধানতঃ রাজা জমিদারদের উদ্যোগেই সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানাদি হতো। তারাই ছিলেন হর্তাকর্তা, উদ্যোক্তা, আয়োজক, ব্যবস্থাপক। আমজনতার সেইসব সভানুষ্ঠানে যোগদান সহজসুলভ ছিলো না। অতীত ইতিহাসে দেখা যায় জমিদার প্রধান এলাকাগুলোই প্রধানতঃ সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। রাজা জমিদারদের মধ্যে অনেকে শিল্পী সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। বিভিন্ন এলাকার মতো জামালপুরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যেমন, শেরপুর জমিদার বাড়িতে নাট্য, নৃত্য, সাহিত্য সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা, অনুরাগ, উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং উদ্যোগ ছিল। জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী মনে-প্রাণে সাহিত্য সংস্কৃতির সাধক ছিলেন। তেমনি সাহিত্য সংস্কৃতির উৎসাহ উদ্দীপনা পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কলাবাঁধা, সরিষাবাড়ী, নান্দিনা, দিগপাইত, জমিদার বাড়ি থেকে। শেরপুরের জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী তৎকালে বৃহত্তম ময়মনসিংহের সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৬৫ সালে তিনি “বিদ্যান্নতি সাহিত্যচক্র” প্রতিষ্ঠা করে এতদঅঞ্চলে সাহিত্যচর্চায় প্রাণ সঞ্চার করেন। এই সাহিত্য চক্রের মাসিক মুখপত্র “বিদ্যান্নতি সাধিনী” বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম সাহিত্য মাসিক হিসেবে বিবেচিত। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত জামালপুর শহরের করোনেশন রিডিং কাব, ব্রাহ্ম-সমাজ লাইব্রেরী ও পাঠাগার ইত্যাদির মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা উদ্দীপ্ত হয়। এসময় কিছু অনিয়মিত ২/১টি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কিছু বিবরণ পাওয়া যায় সাহিত্যিক আলহাজ গোলাম মোহাম্মদ সাহেব বিরচিত “জামালপুরের গণইতিবৃত্ত” গ্রন্থে। সংস্কৃতি সাধণার ক্ষেত্রে বিচিত্র চড়াই-উৎরাই ডিঙ্গিয়ে বর্তমানে জামালপুরের সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যধারা গৌরবময় দিগন্তে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। লণীয় যে, আজকের বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন ধারায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্পী জামালপুরের মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন। জামালপুরের ঐতিহ্যে সংস্কৃতিধারা আজ বিচিত্র বর্ণে গন্ধে বিচিত্র ধারার আঙ্গিকে গর্বে গৌরবে বিকশিত এবং নন্দিত।

হরিষচন্দ্রের দীঘি

পৌরসভার দেউরপাড় চন্দ্রায় অবস্থিত রাজা হরিষচন্দ্রের দীঘি জেলার পুরাকীর্তি গুলোর অন্যতম। রাজা হরিষচন্দ্রের কন্যা চন্দ্রাবতীর প্রেম আলেখ্য লোকসাহিত্যের এক অনন্যোপাখ্যান। সুদূর কাল থেকে এই অঞ্চলে স্বাতন্ত্র্য ঐতিহ্যে ও আবহে মননশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা চলে আসছে। এই দীঘি এখন জামালপুরবাসীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র।

চৈতন্য নার্সারী

প্রাচীনকালে অনেক ঐতিহ্যের মধ্যে ছিল পরলোকগত ঈশ্বর চন্দ্র গুহের চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন। ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহ একজন প্রথিতযশা আইনজ্ঞ ছিলেন। আইন ব্যবসায় উপার্জিত অর্থ ব্যয়ে তিনি মহকুমা শহরের পীঠস্থান বোসপাড়া এলাকায় (লম্বগাছের পশ্চিম পার্শ্বে) ৪৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছিলেন চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন। ১৮৮৪ থেকে ১৮৯৪ এই দীর্ঘ ১০ বছর তিনি বিভিন্ন পরীা-নিরীার মধ্য দিয়ে নার্সারী ও উদ্যানের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন। চৈতন্য নার্সারী ছিলো উপমহাদেশের প্রথম কৃষি ও উদ্যান উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। এই নার্সারী প্রতিষ্ঠাতা ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহ হলেন বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষপ্রথা ও বিদেশী উদ্ভিদ প্রবর্তনের পথিকৃত। এই নার্সারীটি নানা দেশের ৪৬৬৮টি বিভিন্ন জাতের ফুল-ফল, লতা-গুল্ম বাহারি ও অর্থকরী বৃক্ষের পরিব্যাপ্ত ছিল। চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেনের সুখ্যাতি কেবল ততকালীন বৃটিশ-ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ঈশ্বর চন্দ্র গুহ স্বপ্রচেষ্টায় ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, জাভা, মরিশাস, ফিলিপিন, আন্দামান, রাশিয়া, তুরস্ক, পারস্য, আরব, আফগানিস্তান, চীন, মালয় ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ থেকে বহুজাতের দুষ্প্রাপ্য ফল-ফুল, লতা-গুল্ম বাহারি উদ্ভিদ ও মূল্যবান বৃরে চারা ও বীজ এনে নার্সারীতে রোপন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল চৈতন্য নার্সারীকে একটি আদর্শ ও দৃষ্টান্তমূলক নার্সারী ও উদ্যানে পরিণত করা। ঈশ্বর চন্দ্র গুহ ততকালীন কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ফলিত উদ্ভিদ বা কৃষি বিজ্ঞানের উপর অধ্যয়ন করেননি। কিন্তু নার্সারী প্রতিষ্ঠায় যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা করেন তাতে তার বিজ্ঞান মনস্ক পরিচয় মেলে। তিনি বিদেশি উদ্ভিদ এ দেশের মাটিতে বা জলবায়ুতে না জন্মানোর সনাতনী ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলের মৃত্তিকা এনে এ দেশের মৃত্তিকার সঙ্গে গুণগত পার্থক্য নির্ণয় করেন। এ ছাড়াও ঈশ্বর চন্দ্র গুহ চৈতন্য নার্সারীতে অর্থকরী কর্পুর বৃরে চাষ করে ভারত উপমহাদেশের খ্যাতি লাভ করেন। নার্সারী ও উদ্যানটি কেমন পরিব্যাপ্ত ছিল তা নার্সারীর বিশাল ক্যাটালগ সাী। নার্সারীর ক্যাটালগে ৪৬৬৮টি বৃরে নাম রয়েছে। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে যে কয়টি পাম গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো জামালপুরের ঈশ্বর চন্দ্র গুহ প্রতিষ্ঠিত চৈতন্য নার্সারীর লুপ্ত ঐতিহ্য বহন করছে। চৈতন্য নার্সারীর সূতিকাগার ছিল তার ফোরটাঙ্কস গার্ডেন যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে স্থাপিত এদেশের সর্ববৃহত প্রথম আধুনিক উদ্যান। এই উদ্যানটি ফলোদ্যান, ফুলোদ্যান, জলোদ্যান, চারা উৎপাদনের জন্য সিড বেড এবং দুষ্প্রাপ্য ও বিচিত্র জাতের উদ্যান শোভাকর উদ্ভিদ দ্বারা শ্রেণীভেদে ছিল বিভক্ত ও বিন্যস্ত। এ ছাড়াও ছিল উদ্যান অভ্যন্তরে আঁকাবাঁকা পথ, কৃত্রিম পাহাড়, বিরাট চৌবাচ্চা ও গ্রিন হাউজ। উদ্যানের কৃত্রিম সৃষ্টির মধ্যে গ্রিন হাউজটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহের এক বিস্ময়কর ও অনবদ্য সৃষ্টি। যেখানে নিয়ন্ত্রিত উত্তাপে ফার্ণ, অর্কিডসহ বিদেশি বহুজাতের ফুলের চাষ করা হতো। উদ্যান ছিল কীটভুক্ত তরুসহ ৩৬৪ প্রকার দুষ্প্রাপ্য অর্কিড, ৭০০ প্রকার গোলাপ, ৩১১ প্রকার ফার্ণ এবং আফ্রিকার পাম গাছ, ওয়াটার পলি, আমেরিকার আমাজান লিলিসহ এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তিনিই চাষ করে সফল হন। ঈশ্বরচন্দ্র গুহ তার নার্সারীতে উতপন্ন আমাজান লিলি দেশজ নাম দেন ‘নীল পদ্ম’। চৈতন্য নার্সারীটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশ-বিদেশের উদ্যান নার্সারীর জন্য বীজ ও চারা সংগ্রহকারীদের সুবিধার্থে ঈশ্বর চন্দ্র গুহ চৈতন্য নার্সারীর মনোগ্রাম সংবলিত একটি বিজ্ঞাপন ও উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস করে বর্ণানুক্রমে তার বৈজ্ঞানিক ও দেশজ নাম এবং মূল্য তালিকাসহ একটি ক্যাটালগ ছাপিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বোটানিক্যাল গার্ডেন, রাশিয়ার ও মরিশাসের সরকারি বন ও উদ্যানের জন্য এই নার্সারী থেকে বীজ ও চারা বিক্রয়লব্দ অর্থ দিয়ে নার্সারী ও উদ্যানের মালী, শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মচারীদের বেতনভাতা ও পরিচালনা ব্যয় যোগাতেন। দেশ-বিদেশের বহু গুণী-সুধী ও বরেণ্য ব্যক্তিরা এই নার্সারী ও উদ্যান পরিদর্শন করে মুগ্ধ হন। ১৯১৭ সালে বাংলার লাট বাহাদুর লর্ড রোনাল্ডস চৈতন্য নার্সারী পরিদর্শনে জামালপুর মহকুমা শহরে আসেন। ১৯২৩ সালে ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহের ৬৫ বছরের জীববনাসানের পর অর্থ সঙ্কট ও পরিচর্যার অভাবে চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন-এর সজিবতা লুপ্ত হতে থাকে। ঈশ্বর চন্দ্র গুহ দীর্ঘ ৪০ বছরের সাধনায় যে দৃষ্টান্তমূলক নার্সারী ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন তা মৃত্যুর পর মাত্র আশি বছরেই নার্সারী ও উদ্যানের অস্তিত্ব আজ বিলীন। জামালপুর শহরের যে এলাকায় ৪৫ বিঘা জমির উপর ঈশ্বর চন্দ্র গুহের বিজ্ঞান মনস্ক চিন্তায় চৈতন্য নার্সারী এবং ফোরটাঙ্কস গার্ডেন গড়ে উঠেছিল সেখানে কেবলি এখন জনপদ, পাড়া মহল্লা, বাসাবাড়ি, আর ইট-সুড়কির দালানকোঠা। শহরের স্টেশন রোডের শীর্ণবিবর্ণ গর্জন বৃ ও বোসপাড়ার পানির ট্যাঙ্ক সংলগ্ন পাম্প গাছগুলো এখনো চৈতন্য নার্সারীর লুপ্ত ঐতিহ্যের স্মৃতিবহন করছে। (ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় লম্বা গাছটি সম্প্রতি কেটে ফেলা হয়েছে)।

চৈতন্য নার্সারী

প্রাচীনকালে অনেক ঐতিহ্যের মধ্যে ছিল পরলোকগত ঈশ্বর চন্দ্র গুহের চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন। ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহ একজন প্রথিতযশা আইনজ্ঞ ছিলেন। আইন ব্যবসায় উপার্জিত অর্থ ব্যয়ে তিনি মহকুমা শহরের পীঠস্থান বোসপাড়া এলাকায় (লম্বগাছের পশ্চিম পার্শ্বে) ৪৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছিলেন চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন। ১৮৮৪ থেকে ১৮৯৪ এই দীর্ঘ ১০ বছর তিনি বিভিন্ন পরীা-নিরীার মধ্য দিয়ে নার্সারী ও উদ্যানের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন। চৈতন্য নার্সারী ছিলো উপমহাদেশের প্রথম কৃষি ও উদ্যান উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। এই নার্সারী প্রতিষ্ঠাতা ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহ হলেন বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষপ্রথা ও বিদেশী উদ্ভিদ প্রবর্তনের পথিকৃত। এই নার্সারীটি নানা দেশের ৪৬৬৮টি বিভিন্ন জাতের ফুল-ফল, লতা-গুল্ম বাহারি ও অর্থকরী বৃক্ষের পরিব্যাপ্ত ছিল। চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেনের সুখ্যাতি কেবল ততকালীন বৃটিশ-ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ঈশ্বর চন্দ্র গুহ স্বপ্রচেষ্টায় ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, জাভা, মরিশাস, ফিলিপিন, আন্দামান, রাশিয়া, তুরস্ক, পারস্য, আরব, আফগানিস্তান, চীন, মালয় ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ থেকে বহুজাতের দুষ্প্রাপ্য ফল-ফুল, লতা-গুল্ম বাহারি উদ্ভিদ ও মূল্যবান বৃরে চারা ও বীজ এনে নার্সারীতে রোপন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল চৈতন্য নার্সারীকে একটি আদর্শ ও দৃষ্টান্তমূলক নার্সারী ও উদ্যানে পরিণত করা। ঈশ্বর চন্দ্র গুহ ততকালীন কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ফলিত উদ্ভিদ বা কৃষি বিজ্ঞানের উপর অধ্যয়ন করেননি। কিন্তু নার্সারী প্রতিষ্ঠায় যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা করেন তাতে তার বিজ্ঞান মনস্ক পরিচয় মেলে। তিনি বিদেশি উদ্ভিদ এ দেশের মাটিতে বা জলবায়ুতে না জন্মানোর সনাতনী ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলের মৃত্তিকা এনে এ দেশের মৃত্তিকার সঙ্গে গুণগত পার্থক্য নির্ণয় করেন। এ ছাড়াও ঈশ্বর চন্দ্র গুহ চৈতন্য নার্সারীতে অর্থকরী কর্পুর বৃরে চাষ করে ভারত উপমহাদেশের খ্যাতি লাভ করেন। নার্সারী ও উদ্যানটি কেমন পরিব্যাপ্ত ছিল তা নার্সারীর বিশাল ক্যাটালগ সাী। নার্সারীর ক্যাটালগে ৪৬৬৮টি বৃরে নাম রয়েছে। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে যে কয়টি পাম গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো জামালপুরের ঈশ্বর চন্দ্র গুহ প্রতিষ্ঠিত চৈতন্য নার্সারীর লুপ্ত ঐতিহ্য বহন করছে। চৈতন্য নার্সারীর সূতিকাগার ছিল তার ফোরটাঙ্কস গার্ডেন যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে স্থাপিত এদেশের সর্ববৃহত প্রথম আধুনিক উদ্যান। এই উদ্যানটি ফলোদ্যান, ফুলোদ্যান, জলোদ্যান, চারা উৎপাদনের জন্য সিড বেড এবং দুষ্প্রা ও বিচিত্র জাতের উদ্যান শোভাকর উদ্ভিদ দ্বারা শ্রেণীভেদে ছিল বিভক্ত ও বিন্যস্ত। এ ছাড়াও ছিল উদ্যান অভ্যন্তরে আঁকাবাঁকা পথ, কৃত্রিম পাহাড়, বিরাট চৌবাচ্চা ও গ্রিন হাউজ। উদ্যানের কৃত্রিম সৃষ্টির মধ্যে গ্রিন হাউজটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহের এক বিস্ময়কর ও অনবদ্য সৃষ্টি। যেখানে নিয়ন্ত্রিত উত্তাপে ফার্ণ, অর্কিডসহ বিদেশি বহুজাতের ফুলের চাষ করা হতো। উদ্যান ছিল কীটভুক্ত তরুসহ ৩৬৪ প্রকার দু®প্রাপ্য অর্কিড, ৭০০ প্রকার গোলাপ, ৩১১ প্রকার ফার্ণ এবং আফ্রিকার পাম গাছ, ওয়াটার পলি, আমেরিকার আমাজান লিলিসহ এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তিনিই চাষ করে সফল হন। ঈশ্বরচন্দ্র গুহ তার নার্সারীতে উৎপন্ন আমাজান লিলি দেশজ নাম দেন ‘নীল পদ্ম’। চৈতন্য নার্সারীটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশ-বিদেশের উদ্যান নার্সারীর জন্য বীজ ও চারা সংগ্রহকারীদের সুবিধার্থে ঈশ্বর চন্দ্র গুহ চৈতন্য নার্সারীর মনোগ্রাম সংবলিত একটি বিজ্ঞাপন ও উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস করে বর্ণানুক্রমে তার বৈজ্ঞানিক ও দেশজ নাম এবং মূল্য তালিকাসহ একটি ক্যাটালগ ছাপিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বোটানিক্যাল গার্ডেন, রাশিয়ার ও মরিশাসের সরকারি বন ও উদ্যানের জন্য এই নার্সারী থেকে বীজ ও চারা বিক্রয়লব্দ অর্থ দিয়ে নার্সারী ও উদ্যানের মালী, শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মচারীদের বেতনভাতা ও পরিচালনা ব্যয় যোগাতেন। দেশ-বিদেশের বহু গুণী-সুধী ও বরেণ্য ব্যক্তিরা এই নার্সারী ও উদ্যান পরিদর্শন করে মুগ্ধ হন। ১৯১৭ সালে বাংলার লাট বাহাদুর লর্ড রোনাল্ডস চৈতন্য নার্সারী পরিদর্শনে জামালপুর মহকুমা শহরে আসেন। ১৯২৩ সালে ঈশ্বর চন্দ্র্র গুহের ৬৫ বছরের জীববনাসানের পর অর্থ সঙ্কট ও পরিচর্যার অভাবে চৈতন্য নার্সারী ও ফোরটাঙ্কস গার্ডেন-এর সজিবতা লুপ্ত হতে থাকে। ঈশ্বর চন্দ্র গুহ দীর্ঘ ৪০ বছরের সাধনায় যে দৃষ্টান্তমূলক নার্সারী ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন তা মৃত্যুর পর মাত্র আশি বছরেই নার্সারী ও উদ্যানের অস্তিত্ব আজ বিলীন। জামালপুর শহরের যে এলাকায় ৪৫ বিঘা জমির উপর ঈশ্বর চন্দ্র গুহের বিজ্ঞান মনস্ক চিন্তায় চৈতন্য নার্সারী এবং ফোরটাঙ্কস গার্ডেন গড়ে উঠেছিল সেখানে কেবলি এখন জনপদ, পাড়া মহল্লা, বাসাবাড়ি, আর ইট-সুড়কির দালানকোঠা। শহরের স্টেশন রোডের শীর্ণবিবর্ণ গর্জন বৃ ও বোসপাড়ার পানির ট্যাঙ্ক সংলগ্ন পাম্প গাছগুলো এখনো চৈতন্য নার্সারীর লুপ্ত ঐতিহ্যের স্মৃতিবহন করছে। (ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় লম্বা গাছটি সম্প্রতি কেটে ফেলা হয়েছে)।