জামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন গুলো অবহেলিত


স্বাধীনতার ৩৫ বছর পরও অবহেলিত জামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন গুলো। যথাযথ পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে ১১ নং সেক্টরের অধীন জামালপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও বধ্যভূমিগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। গুরুত্বপূর্ণ এই রণাঙ্গনের স্মৃতিচিহ্ন গুলো সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় নতুন প্রজন্মের নিকট মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা আড়ালে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একাত্তরে যুদ্ধের শুরুতেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও আশ-পাশের বেশক’টি জেলা নিয়ে ১১নং সেক্টর গঠিত হয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার মহেন্দ্রগঞ্জ এলাকায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১নং সেক্টরের হেড কোয়াটার স্থাপন করা হয়। বিপরীতে জামালপুর জেলা সদরের পিটিআই ও ধানুয়া কামালপুরে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ১১নং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এই সেক্টরের অনেক যুদ্ধই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পেয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে হানাদার বাহিনীর অসংখ্য নৃশংতার চিহ্ন আর বধ্যভূমি ছড়িয়ে আছে জেলার বিভিন্ন স্থানে। জেলা সদরের পিটিআই হেড কোয়াটার, বর্তমান ওয়াপদা রেস্ট হাউস, আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেল টর্চার সেল, ব্রক্ষপুত্রের তীরে শ্মশান ঘাট বধ্যভূমি, ফৌতি গোরস্থান বধ্যভূমিতে ধরে এনে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সরিষাবাড়ির বারই পটল এলাকায় একদিনেই হত্যা করা হয় শতাধিক মুক্তিকামী বাঙ্গালীকে। বারই পটল ছাড়াও সীমান্তবর্তী কামালপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অন্ততঃ ১৫টি গণকবর। স্বাধীনতার ৩৫ বছর যাবত মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচিহ্ন অযত্ন অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রি হোস্টেল টর্চার সেল পরিণত হয়েছে গরুর খোয়াড়ে। একমাত্র কামালপুর বিডিআর ক্যাম্প আর শ্মাশন ঘাট বধ্যভূমি ছাড়া জেলার কোথাও উলেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা তুলে ধরতে টর্চার সেল, বধ্যভূমি, গণকবরসহ সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে এটাই এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের দাবি।

জামালপুর জেলার উপজেলা সমূহের নামকরণ ও পরিচিতি


বকশীগঞ্জ : এই উপজেলার আয়ন ২০৪.৩০ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১,৭৭,৮৮০ জন। এখানে থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ সালে। জানা যায়, আধ্যাত্মিক মতা সম্পন্ন দরবেশ বকশী ফকির ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে আসেন এবং এখানে একটি খানকাহ্ স্থাপন করেন। কালক্রমে তাঁর এই খানকাহকে কেন্দ্র করে এখানে একটি গঞ্জ গড়ে উঠে। এই গঞ্জ এলাকাবাসীর কাছে বকশী ফকিরের গঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। এই বকশী ফকিরের গঞ্জ থেকে বখশীগঞ্জ নামে উদ্ধব।
দেওয়ানগঞ্জ : এই উপজেলার আয়তন ২৬৬.৫৯ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ২,২৯,২২০ জন। এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৪ সালে। জনশ্র“তি রয়েছে, প্রায় দুশো বছর পূর্বে দেওয়ান শাহ জালাল ও দেওয়ান শাহ জামাল নামে দুই কামেল পীর গারো পাহাড়ে তাঁদের দরগা শরীফে যাওয়ার সময় বর্তমান থানা সদরের এই স্থানে কিছু সময়ের জন্য থেমে বিশ্রাম নেন। এই দুই কামেল পীরের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য জায়গার নাম রাখা হয় দেওয়ানগঞ্জ।
ইসলামপুর : এই উপজেলার আয়তন ৩৪৩.০২ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ২,৮৮,০৪০ জন। এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৪ সালে। ইসলামপুর উপজেলার নামকরণ সম্পর্কে দু’টি মত প্রচলিত আছে। প্রথম মতানুসারে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বাংলার গভর্ণর ছিলেন সুবেদার ইসলাম খাঁ। ইসলামপুর নামকরণ করা হয় সুবেদার খাঁর নামানুসারে। অন্যতম, শতাধিক বছর পূর্বে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ইসলামপুর নামে একটি মৌজা ছিল। এই মৌজায় স্থানীয় জনগণ একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করে। থানা সৃষ্টি হলে থানার নামকরণ হয় ওই মৌজার নামানুসারে।
সরিষাবাড়ি : এই উপজেলার আয়তন ২৬৩.৪৮ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ৩,১৭,৫৪০ জন। এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয় ২৯ আগষ্ট ১৯৬০ সালে। বলা হয়ে থাকে, এই এলাকায় এককালে প্রচুর উন্নতমানের সরিষা উৎপন্ন হতো। এই সরিষাকে কেন্দ্র করে এখানে বেশ কিছু হাট-বাজার গড়ে উঠে। এই সরিষা ও ব্যবসার কারণে কালক্রমে এই এলাকা সরিষাবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
মেলান্দহ : এই উপজেলার আয়তন ২৩৯.৬৫ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ২,৯১,৬৮০ জন। এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয় ২১ মে ১৯২৫ সালে। জানা যায়, প্রায় দুশো বছরেরও বেশি পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা লৌহজং নদী দোহা সংলগ্ন স্থানে বেশ কিছু প্রচণ্ড ঘূর্ণি সৃষ্টি করে দণি-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতো। কালক্রমে এই দোহা “মিলন দোহা” নামে পরিচিতি পায় এবং লোক মুখে তা বর্তমান মেলান্দহ রূপ লাভ করে।
মাদারগঞ্জ : এই উপজেলার আয়তন ২২৫.৩৮ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ২,৩৩,১০০ জন। এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬ জুন ১৯০৬ সালে। জামতাল মাদারগঞ্জ নামের একটি মৌজা থেকে এই উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। মৌজাটি অনেক আগেই যমুনায় বিলীন হয়ে গেছে।
জামালপুর সদর : এই উপজেলার আয়তন ৪৯৮.৫৬ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ৫,৫৬,৫৮০ জন। এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে। জনশ্র“তি আছে, বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহ জামাল (রহ:) এর নামানুসারে জামালপুর নামকরণ করা হয়। (উৎস - বাংলাদেশের জেলা-উপজেলার নামকরণ ও ঐতিহ্য)

মহকুমা থেকে জেলা


অতীতকাল থেকে পর্যায়ক্রমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারায় আঞ্চলিক গুরুত্ব বৃদ্ধির সাথে জামালপুরকে প্রশাসনিক জেলায় রূপান্তরের দাবি উঠেছিল দীর্ঘদিন আগেই। বৃটিশ শাসনামলে জামালপুর মহকুমার আয়তন ছিল ১৩১৫ বর্গমাইল। জামালপুর সদর থেকে সমগ্র অঞ্চলের আইন শৃংঙ্খলা ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল মহকুমার হাকিম ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার উপর। এ সমগ্র অঞ্চলের শাসনভার বিকেন্দ্রীকরণ করার ল্েয তদানিন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর স্যার রিচার্ড টেম্পল ১৮৭৬ সালে জামালপুরকে জেলায় প্রস্তাব করেন। এরপর ১৯১২ সালে বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন জামালপুরকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রশাসনিক জেলায় উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯১৭ সালে জেলা গঠনের জন্য ৩৯২.৪৫১ একর জমি পৌর এলাকায় অধিগ্রহণ করা হয়। সে সময় জামালপুর শহর সংলগ্ন পাথালিয়া, দেওয়ানপাড়া, বনপাড়া, চন্দ্রাবাসীরা নামমাত্র মূল্যে তাদের ভূমির স্বত্ব ত্যাগ করে অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত করেছিলেন। উক্ত অধিগ্রহণকৃত জমিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জজ কোর্ট, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জিলা স্কুল, জেলখানা, পৌরসভা, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনার নীল নকশা পর্যন্ত তৈরী করা হয়েছিল। বর্তমান সময়ে উক্ত অধিকৃত ৯৩ বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে সরকারী আশেক মাহ্মুদ কলেজ, কৃষিফার্ম, বিডিআর ক্যাম্প, হাসপাতাল, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও স্টেডিয়াম। বিশ্বযুদ্ধের দামামা এবং দেশ বিভক্তির আন্দোলন ও নানা ডামাডোলের মধ্যে জেলার দাবিটি চাপা পড়ে যায়। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত পট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর আবারো জেলা ঘোষণার দাবি সোচ্চার হয়ে উঠে। ১৯৭৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জামালপুর মহকুমাকে বাংলাদেশের ২০তম জেলা রূপান্তরের ঘোষণা করেন। ১৯৭৯ সালের ১ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নবগঠিত জেলার প্রশাসনিক কর্মকান্ডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। নবগঠিত এই জেলায় প্রথম জেলা প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জনাব নুরুল ইসলাম।

একাত্তরের উত্তাল মার্চ


“ভূট্টোর মুখে বেল মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করোশ্লোগান আর প্রতিরোধের অগ্নি ঝরা জামালপুর।’রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ৯ মার্চ তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত এমএলএ এডভোকেট আব্দুল হাকিমের সভাপতিত্বে স্থানীয় স্টেশন রোডস্থ এম সরফুদ্দিনের বাসায় এডভোকেট মতিয়ুর রহমান তালুকদারকে আহ্বায়ক ও রেজাউল করিম হীরাকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৫১ সদস্যের সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন নির্বাচিত এমএলএ এডভোকেট আব্দুল হাকিম, এডভোকেট আনিছুর রহমান, আব্দুল হাকিম সরকার, আব্দুস সামাদ, করিমুজ্জামান তালুকদার, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এডভোকেট আখতারুজ্জামান, আব্দুল হাই বাচ্চু, আব্দুল মালেক, রাশেদ মোশাররফ, আশরাফ হোসেন, এডভোকেট আব্দুল হালিম, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ নাদেরুজ্জামান খাঁন, ইসলামপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আক্রামুজ্জামান ও সৈয়দ আলী মন্ডল। ওই সময় ১০টি থানায় সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠিত হয়। ইতোপূর্বে ১১ দফা আন্দোলনের ভিত্তিতে তৎকালীন মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃস্থানীয় সদস্যরা ছিলেন ফজলুল বারী তারা, সিদ্দিকুর রহমান, মাহবুবুর রহমান আনসারী, কাছারী পাড়ার আনোয়ার সহ অসংখ্য ছাত্র যুবক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মানুষ বুঝে নেয় যুদ্ধ ছাড়া মুক্তি নেই। তাই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চলতে থাকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। প্রতিদিন হাজারো মানুষের মিছিলে শ্লোগান ওঠে ঃ “সব কথার এক কথা-বাংলার স্বাধীনতা, ভুট্টোর মুখে বেল মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো।” ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আশেক মাহমুদ কলেজের রোভার স্কাউটের ডামি রাইফেলে কলেজ প্রাঙ্গণ, স্থানীয় তমালতলা, হাই স্কুল মাঠে ও গৌরিপুর কাচারী মাঠে চলতে থাকে ছাত্র যুবকদের যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রশিণ। এ সময় যশোর থেকে ট্রেন যোগে আর্মির একটি এন্ট্রি এয়ার ক্র্যাফট ঢাকার উদ্দেশ্যে জামালপুর অতিক্রমের সময় স্টেশন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্ররা আটক করে। প্রায় ৫ ঘন্টা অবাঙ্গালী আর্মি অফিসার সহ ছাত্ররা এন্ট্রি এয়ার ক্র্যাফটি আটকে রাখে। পরে ময়মনসিংহ থেকে বাঙ্গালী ইপিআর এয়ার ক্র্যাফটটি গ্রহণ করবে প্রতিশ্র“তি দিলে ছাত্ররা তা ছেড়ে দেয়। ২৫ মার্চ পর্যন্ত জামালপুর ছিল উত্তাল মিছিলের শহর। দাবি একটাই বাংলার স্বাধীনতা। লাঠি সোঠা, রামদা, ডামি রাইফেল এবং সুপুরি গাছ দিয়ে নকল এন্ট্রি এয়ার ক্র্যাফট বানিয়ে ছাত্র যুবকরা মিছিলে যোগ দিতো।
ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর হানাদার বাহিনীর হামলার খবর জামালপুর পৌছার পর ছাত্র যুবকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১২ মার্চ গৌরিপুর কাছারী মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এক বিরাট জনসভায় সর্বস্তরের মানুষের প্রতি হানাদার প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়। সভায় ছাত্র নেতা হাফিজুর রহমান বাদশা আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তান পতাকায় আগুন ধরায় এবং আব্দুল মতিন হিরু স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়। এখানে “আমার সোনার বাংলা” গানটি পরিবেশন করেন সুশান্ত কুমার দেব কানু। একই দিন নতুন হাই স্কুলে সংগ্রাম পরিষদের অফিস উদ্বোধনের সময় পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। একই দিন ছাত্ররা তৎকালীন অবাঙ্গালী এসডিও ইমতিয়াজ জাভেদকে ধরে এনে ছাত্রদের সাথে জয় বাংলা শ্লোগান সহ মিছিল করায়। ২৬ মার্চ স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণ ভাবে সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। অবাঙ্গালী এসডিও ইমতিয়াজ জাভেদ ও অবাঙ্গালী মহকুমা পুলিশ অফিসারকে নিরাপদ জেল হাজতে পাঠানো হয়। ভারপ্রাপ্ত এসডিওর দায়িত্ব দেয়া হয় সেকেন্ড অফিসার আব্দুর রশিদকে। এর আগে ২৬ মার্চ সকালে আনোয়ার হোসেন চাঁন, ফজলুল বারী তারা, সৈয়দ আলী মন্ডল, ফয়েজুর রহমান, আঃ মজিদ আকন্দ, আনিছুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্র যুবকরা তৎকালীন মহকুমা আনসার এ্যাডজুটেন্ট ফজলুল হক কে (পরে শহীদ) বাসা থেকে ডেকে এনে আনসার এ্যাডজুটেন্ট এর চাবি দিয়ে ট্রেজারী খুলে ৪৩০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল (গুলিসহ) নিয়ে এমএলএ আব্দুল হাকিমের জিপে করে পাথালিয়াস্থ তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই রাইফেল গুলো মুজাহিদ, আনসার ও প্রশিণ প্রাপ্ত ছাত্র যুবকদের মধ্যে বিলি করা হয়। জামালপুরের তৎকালীন পুলিশ সহ সর্বস্তরের প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিরোধ প্রস্তুতির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সীমান্ত থেকে কয়েক’শ বাঙ্গালী ইপিআর সদস্য হানাদার প্রতিরোধে অংশ নেয়ার জন্য জামালপুর চলে আসে। মুজাহিদ বাহিনী, আনসার, ইপিআর, ছাত্র, যুবকের যৌথ প্রতিরোধ বাহিনী স্থানীয় প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ক্যাম্প স্থাপন করে। শহর থেকে জামালপুর-ঢাকা মহাসড়কে দু’কিলোমিটার বেলটিয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ বাহিনী ব্যাংকার স্থাপন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সংগ্রাম পরিষদ ও প্রতিরোধ বাহিনীর আরেক ঘাটি স্থাপন করা হয় স্থানীয় হাই স্কুলে। প্রতিরোধ বাহিনীর জন্য জনগণের স্বতঃর্স্ফুত ভাবে দেয়া খাবার সংগ্রহ ও ক্যাম্পে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করতেন দিদারুল আলম খুররম, সৈয়দ আলী মন্ডল, আঃ মজিদ আকন্দ, ময়েন মন্ডল, সাদু, মহসিন মিয়া প্রমুখ। ছাত্র ইউনিয়নের একটি টিম মটর গাড়িতে কাঠের বন্ধুক সাথে করে যুদ্ধ প্রস্তুতি ও সংগঠিত করার কাজে সার্বণিক দায়িত্ব পালন করতো। এ দায়িত্ব ছিল হাকিম ও রশিদের উপর। এ সময় প্রতিদিন ডামি রাইফেল নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীনতার পে মিছিল করতো। মিছিলে মাহবুবুর রহমান আনসারী, ফয়েজুর রহমান, হাবিবুর রহমান হবি, মেজবাহ আহম্মেদ, সুরুজ্জামান, আলী জহির, জাহিদ হোসেন রবিসহ অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী অংশ নিতো। ৬ এপ্রিল তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট আঃ হাকিম এমএনএ, ভারপ্রাপ্ত এসডিও আঃ রশিদ ও সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল করিম হীরা ভারতের তুরা জেলায় যান ভারতীয় কর্তৃপরে সাথে কথা বলার জন্য। তারা মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলা প্রশাসন ও ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সাথে কথা বলেন। তাদের আশ্বাস পেয়ে ফিরে এসে মুক্তিবাহিনী গঠনে আরো সক্রিয় হন। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের অধীনে অর্থ উপ-পরিষদ, সশস্ত্র বাহিনী উপ-পরিষদ সহ কয়েকটি উপপরিষদ গঠন করা হয়। ১৪ এপ্রিল শহরের মালগুদাম, স্টেশন ও শেরপুর গোদারা ঘাটে পাকিস্তানী বাহিনী বিমান হামলা চালায়। বিমান হামলায় নৌকার মাঝি ফজলু ও অন্য ছয়জন শহীদ হন। ইতোপূর্বে প্রতিরোধ বাহিনী জামালপুর-ঢাকা সড়কের একটি সেতু বোমা মেরে ধ্বংসের চেষ্টা করে। কিন্তু বোমায় সেতুর আংশিক তি হয় মাত্র। ১৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী মধুপুর অতিক্রম করে জামালপুর জেলায় প্রতিরোধ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। প্রতিরোধ বাহিনীর যোদ্ধারা রাত পর্যন্ত তাদের হালকা অস্ত্রে হানাদার বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখে। হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে পরদিন পিছু হটে ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিরোধ বাহিনী ২১ এপ্রিল পিছু হটে ভারতের ঢালু, মহেন্দ্রগঞ্জ, বারাঙ্গা পাড়া ও পুরো খাসিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানেই গড়ে তোলা হয় ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প ও মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প। ২২ এপ্রিল হানাদার বাহিনী জামালপুর ঢুকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বেলটিয়া ও পাথালিয়ায় অসংখ্য বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হানাদার বাহিনী শুধুমাত্র পাথালিয়ায় ১১’শ ৭২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। হানাদাররা তৎকালীন মহকুমা আনসার এ্যাডজুটেন্ট ফজলুল হককে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। হানাদাররা পাথালিয়ার ছাত্রলীগ নেতা আঃ হালিম ও বেবী চালক সোলেমানকে ধরে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। হানাদাররা যুদ্ধকালীন সময়ে হত্যা করে প্রাক্তন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুল হামিদ মোখতার, কেন্দুয়া কালিবাড়ীর মজনু, সংগ্রাম পরিষদ সদস্য কামরুদ্দিন খোকা, লাহিড়ী কান্দার আওয়ামী লীগ নেতা ময়নাল হক সহ নাম না জানা অসংখ্য স্বাধীনতা কামী বাঙ্গালীকে। সূত্র ঃ সংশ্লিষ্টদের সাাৎকার নিয়ে শফিক জামান
খেলাধুলা জামালপুরের আলো-বাতাস, আকাশ, মাটি গুণী শিল্পী সাধকের অনুকূল লালনত্রে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের সাংবাৎসরিক উৎসব পালনের পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে। এই সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই ও চঙ্গদৌড়, লাঠিখেলা, হা-ডু-ডু (কাবাডি) ও ফুটবল অত্যন্ত সমাদৃত। সম্প্রতি এই জেলায় আধুনিক খেলাধুলার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। খেলাধূলাচর্চা ও মান উন্নয়নের ল্েয ১৯৬২ সালে জামালপুর স্টেডিয়াম স্থাপিত হয়। এই স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্থানে রয়েছে একটি ব্যায়ামাগার ও ক্রীড়া প্রশিণ কেন্দ্র।
মুক্তিযুদ্ধে জামালপুর রণাঙ্গন রাজনৈতিক ইতিহাসে ইংরেজ আমলে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীলকর বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ ও জমিদার অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। দেশ বিভাগ পরবর্তী সময়ে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান ও সর্বপরী ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে জামালপুরবাসীর গৌরবোজ্জল অবদান। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তৎকালীন এমএলএ ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হাকিম, মতিয়ুর রহমান তালুকদার, রেজাউল করিম হীরা, ময়েন উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আলী মন্ডলসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের নেতৃত্বে প্রতিদিন চলে বিােভ-সমাবেশ। পাশাপাশি চলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি। ’৭১-এর ২২ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত জামালপুর দখল করে নিয়ে চালায় গণহত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। এদিন সন্ধ্যায় শহরের মেডিকেল রোড, ঢাকাই পট্টি, পাথালিয়া, বকুলতলাসহ অনেক এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। রাতভর আগুনে শহরের অধিকাংশ এলাকা পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। এদিন চলে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের ব্যাপক লুটতরাজ। বিজয় : ১৬ই ডিসেম্বর দেশ শত্র“মুক্ত হলেও এর পাঁচদিন পূর্বে ১১ই ডিসেম্বর প্রচন্ড যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী অমিত বিক্রমে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে জামালপুরে বিজয় পতাকা উড়ান। জামালপুর অঞ্চলকে পাকহানাদার মুক্ত করার পেছনে ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ সময়ে ৪ ডিসেম্বর জামালপুরের ঐতিহাসিক কামালপুর রণাঙ্গন হানাদার মুক্ত হয়। উত্তর রণাঙ্গনে হানাদার পাক বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাটি কামালপুর দুর্গ পতনের মধ্য দিয়েই সূচিত হয় মূলতঃ ঢাকা বিজয়ের পথ। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার সীমান্তবর্তী জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুরে পাক হানাদার বাহিনী গড়ে তুলে শক্তিশালী দুর্ভেদ্য ঘাটি। ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহেরের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর দুর্গ আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে কমপে ৮ দফা এই দুর্গে আক্রমন করে। প্রচন্ড যুদ্ধের পরও এই দুর্গ দখলে ব্যর্থ হয়। শহীদ হয় ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন মমতাজসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। সর্বশেষ ১৪ নভেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শক্রর গোলার আঘাতে একটি পা হারান সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের। আহত অবস্থায়ও কর্ণেল তাহেরের নির্দেশ ছিল যে কোন মূল্যে কামালপুর দুর্গ দখলের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর এই ঘাটি ঘিরে চতুর্মুখী অবরোধ সৃষ্টি করে। ঘাটি রায় মরিয়া হানাদার বাহিনীর সাথে শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর সদর দপ্তর জামালপুরের সাথে কামালপুরের সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে পাকসেনাদের খাদ্য ও গোলাবরুদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ১০ দিন কামালপুর দুর্গ অবরোধ থাকার পর পাকসেনারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। ৪ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় মিত্র বাহিনীর মেজর রনজিত কুমার সিং এর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা বছির আহম্মেদ সাদা পতাকা দিয়ে আত্মসর্মপণের আহবান সম্বলিত একটি চিরকুট নিয়ে হানাদার দুর্গ কামালপুর ক্যাম্পে যায়। হানাদাররা তাকে আটকে রাখলে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু মিয়াকে পাঠানো হয় হানাদার দুর্গে আত্মসমর্পণের আহ্বান চিঠি দিয়ে। তাকেও আটকে রাখা হলে মুক্তি বাহিনী মিত্র বাহিনীর সহায়তায় চতুর্মুখী আক্রমণ চালায় এই দুর্গে। এক পর্যায়ে হানাদাররা বিকেল ৫টায় আত্মসমর্পণের সম্মতি পত্র সহ মুক্তিযোদ্ধা বছির আহম্মেদকে ফেরত পাঠায়। ২৪ নভেম্বর থেকে ১০ দিন ব্যাপী লাগাতার রক্তয়ী যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭ টায় হানাদার বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার আহসান মালিক খান ১৬২ জন পাকসেনাসহ মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। পতন হয় কামালপুর ঘাটির। সূচিত হয় ঢাকা বিজয়ের পথ। কামালপুরের চুড়ান্ত যুদ্ধে ধানুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বীর প্রতীক, নুর ইসলাম বীর প্রতীক গুরুতর ভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। শহীদ হন আলীর পাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান ও সুর্যনগর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তসলিম উদ্দিন। ১০ দিন ব্যাপী এই রক্তয়ী যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রায় শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। কামালপুর পতনের পর ক্রমান্বয়ে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল পতনের পর ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা উপনীত হয় ঢাকার উপকণ্ঠে। ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের কামালপুর ঘাটি অবরোধ এবং বীরোচিত আক্রমণে ৪ ডিসেম্বর এই ঘাঁটির পতনের পর ছিলো এক ঐতিহাসিক বিজয়। কামালপুরের পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি পতনের পর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের পাক হানাদাররা একযোগে পশ্চাদপসারণ করে জামালপুরে অবস্থিত হেড কোয়ার্টার প্রতিরায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অপ্রতিরোধ্য মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ৩১ বালুচের হেড কোয়ার্টারের চারদিক ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মিত্রবাহিনীর একটি চিঠি নিয়ে পিটিআই ক্যাম্পে গেলে পাক বাহিনী তার ওপর নির্মম নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের চতুরমুখী আক্রমন ও ১০ ডিসেম্বর দিন-রাতব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধের পর গভীর রাতে অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ভোরে লেঃ কর্নেল সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বাধীন হানাদার বাহিনী পশ্চাদপসারণ করে। ভোর সাড়ে ৪ টায় পাকিস্তানী বাহিনী নি:স্তব্ধ হয়ে যায়। অল্প কিছুণের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর একটি দল গগন বিদারী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে চারদিক থেকে জামালপুর শহরে প্রবেশ করেন। রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিকামী মানুষেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি শত্র“মুক্ত হানাদারবাহিনীর ঘাটি পিটিআই-এ আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজয় পতাকা উত্তোলন করে। জামালপুর মুক্ত হওয়ার যুদ্ধে ২৩৫ জন পাক বাহিনী নিহত, ২৩ জন আহত হয়। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড সহ ৩৭৬ জন পাক সেনা। ক’দিনব্যাপী ভয়াবহ যুদ্ধে শহীদ হয় মিত্রপরে মারাঠা লাইট ইনফ্যান্টির ১০ জন জওয়ান ও ১৩ গার্ড রেজিমেন্টের ১ জন জওয়ান।

নয়নাভিরাম গারো পাহাড়

সৌন্দর্য্যে ঐশ্বর্য্যে প্রকৃতির রূপে লাবণ্যে মনমুগ্ধকর নৈসর্গিক সৌন্দর্যবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকার জামালপুর জেলায় বকশিগঞ্জের গারো পাহাড়। আমাদের গারো পাহাড়ও নজর কেড়েছে দেশের ভ্রমণবিলাসী দর্শনার্থীদের। আমরা নতুন কিছু দেখার, পাওয়ার আশায় উম্মুখ চিরকাল। আর তা যদি হয় হাতের কাছে, তবে সব কিছু ভুলে ছুটে যাওয়ার তাগিদ মনকে তাড়া দেয়। এমনই এক জায়গা লাউ চাপড়া।
অবস্থান ঃ জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে সরকারি ৭ হাজার ৯৯ একর ৬২ শতাংশ জায়গা জুড়ে গারো পাহাড়। এছাড়াও আদিবাসীদের কাছ থেকে ক্রয়কৃত ব্যক্তি মালিকানায় রয়েছে বেশ কিছু পাহাড়, বনভূমি। ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নের লাউ চাপড়া ও ডুমুরতলা মৌজার পুরোভাগই প্রায় বনভূমি।
কেন আসবেন ঃ প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য্যরে মহিমায় উদ্ভাসিত একটি গ্রামীণ জনপদ। পাথর আর বনরাজির অপূর্ব সম্মীলন আকর্ষণ করেছে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের। অসংখ্য পর্যটক শীতের কুহেলিকা আর পাখির গানের টানে এখানে আসেন। আর তাই শীত মৌসুমের প্রতিদিন অসংখ্য অতিথির পদভারে সেই নি:ভৃত অঞ্চলটিও প্রাণ প্রায় মৌসুম উৎসবের।এখানে ১৯৯৬ সালে জামালপুর জেলা পরিষদ ২৬ একর জায়গায় গারো পাহাড়ের চূঁড়ায় নির্মাণ করেছে পিকনিক স্পট “ণিকা”। ণিকা পিকনিক স্পটে ১৫০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় নির্মিত হয়েছে ৬০ ফুট উঁচু সুরম্য টাওয়ার। প্রতিদিন শত শত কার, বাস, মাইক্রোবাসে আসা হাজার হাজার মানুষের কলরবে এই লাউ চাপড়ার ণিকা পিকনিট স্পটটি হয়ে উঠে মুখরিত। শীত মৌসুমে পর্যটকদের আসা, থাকা এবং যাওয়াকে নিশ্চিত আর নিরুদ্বিগ্ন করতে ণিকা পিকনিক স্পটের পাশে সম্পূর্ণ ব্যক্তি মালিকানায় একটি বিলাসবহুল টুরিস্ট কমপ্লেক্সও গড়ে উঠেছে । এখানে অবস্থান করে প্রকৃতি উপভোগ করা যায় খুব সহজেই।
কি দেখবেন ঃ গারো পাহাড়ের চূঁড়ায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে চোখে পড়বে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। যেন সবুজ গালিচায় মোড়ানো প্রকৃতি। এসব পাহাড়ের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় স্বচ্ছ পানির অজস্র ঝরণাধারা। নানা জাতের পাখির কলকাকলি। কোথাও গহীন জঙ্গল। আবার কোথাও কোথাও দেখা যাবে বৃহীন ন্যাড়া পাহাড়। আরো দেখা যাবে ওপারে সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়ের সুবি¯তৃত পাহাড় এবং ভারত সীমান্ত। পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দর্শন। এছাড়া হেঁটে চারদিকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে মনোরম পরিবেশ। পাহাড়ের বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে বাহারি গাছ-গাছালিতে সৌন্দর্যমন্ডিত সবুজের সমারোহ।
যাদের বসবাস ঃ দিঘলাকোনা, বালুঝুড়ি, সাতানিপাড়া, পলাশতলা, লাউ চাপড়া, মেঘাদল, শুকনাথপাড়া প্রভৃতি গ্রামের গহীন গারো পাহাড়ের চুঁড়ায় কিংবা পাশে কোল ঘেঁষে সবুজের আড়ালে খড়ের অথবা মাটির ঘরে বসবাসরত গারো, কোচ ও হাজংসহ বিভিন্ন আদিবাসী উপজাতি।
সম্পদ ঃ এই বিশাল গারো পাহাড়ে রয়েছে অনেক খনিজ সম্পদ। এর মধ্যে নুড়ি পাথর, বোল্ডার পাথর প্রসিদ্ধ। পাহাড়ি সম্পদ আহরণে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ব্যাপক ভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি উদ্যোগের অভাবে বর্তমানে চোরাকারবারী দল অবৈধভাবে পাহাড় কেটে বালি, পাথর উত্তোলন করছে। সেই সাথে বিনষ্ট করছে পাহাড়ের মূল্যবান বৃক্ষ। ফলে পাহাড়ের বনভূমিতে মারাত্মক তিসাধন ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
সম্ভাবনা ঃ লাউ চাপড়া ণিকা পিকনিট স্পটকে ঘিরে সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠার ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা থাকলেও এর কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন। ফলে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র থেকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই গারো পাহাড়ের লাউ চাপড়া পিকনিট স্পটটিতে টেলিফোন লাইন সংযোগ ও বিদ্যুৎ সুবিধাসহ সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলে লাউ চাপড়া পিকনিট স্পটটি হয়ে উঠবে দেশের আর একটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পর্যটন কেন্দ্র। চিরসবুজ ঘেরা নয়নাভিরাম গারো পাহাড়ের নিবিড় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেশের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান পর্যটন স্পটের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়।

প্রথম শহীদ মিনার

জামালপুরে প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৬৩ সালে। আশেক মাহমুদ কলেজের বড় পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোনে ভাষা সৈনিক সুজায়াত আলী, কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি এসএম সাত্তার, ছামিউল হক, ছাত্রনেতা শাহনেওয়াজ, মোখলেছুর রহমান আনসারীকে নিয়ে কয়েকটি ইট দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন। এ সময় তৎকালীন অবাঙ্গালী এসডিও শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলে কলেজের মঞ্জুরী কেটে দেয়া হবে হুমকি দেন। কিন্তু হুমকি উপো করে ছাত্ররা চাঁদা তুলে শহীদ মিনারের বেদী নির্মাণ করেন এবং ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে প্রভাত ফেরি করে সদ্য নির্মিত বেদীতে ফুল দেন। ১৯৬৩ সালে কলেজ ছাত্র সংসদের নেতা ওয়াহেদুজ্জামানের উদ্যোগে প্রথম বেদিতে একটি স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত এই শহীদ মিনারেই প্রভাতফেরি শেষে ফুল দিয়ে স্মরণ সভা করে শহীদ দিবস পালন করা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন দয়াময়ী পাড়া শাখার উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের ফেব্র“য়ারিতে ভাষা সৈনিক সুজায়াত আলী শহরের মাঝখানে পুনাই পার্কে তিনটি স্লাব দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন। এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ড. ফরাস উদ্দিন (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর)। ১৯৭০-এর ফেব্র“য়ারিতে পুনাই পার্কের শহীদ মিনারের সামান্য সংস্কার করা হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনেক অনুষ্ঠান হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী কলেজ পুকুর পাড়ে শহীদ মিনারের পিলার এবং পুনাই পার্কের শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। ১৯৭২ সালে পুনরায় পুনাই পার্কে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপিত হয় ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে। পরে ১৯৭৭ সালে পৌরসভা চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী চাঁন চৌধুরী আহ্বায়ক, ফয়েজুর রহমান, সুকুমার চৌধুরী, উৎপল কান্তি ধর, আলী জহির, নজরুল ইসলামসহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সদস্য করে পুনাই পার্কের শহীদ মিনার সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির তত্ত্বাবধানে পুনাই পার্কের শহীদ মিনারটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারে রূপ পায়। এই শহীদ মিনারটি এখন জামালপুর শহরের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র।
সক্রিয় ভাবে (উল্লেখযোগ্য) যারা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন ঃ সৈয়দ আব্দুস সোবহান, আক্তারুজ্জামান মতি, দিদারুল আলম খুররম, সুজায়াত আলী, ফজলুল করিম মিঠু, আলী আসাদ কালা খোকা, ফজলুল হক সাদা খোকা (ওস্তাদ), জর্জিস আহমদ খান, ডাঃ সোহরাব উদ্দিন আকন্দ, সৈয়দ ইমামুর রশিদ, হায়দার আলী মল্লিক, তাছির উদ্দিন আহম্মেদ মোক্তার, গিয়াস উদ্দিন, বাদশাহ আনসারী, নিজাম উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আক্তারুজ্জামান, আব্দুর রহমান সিদ্দিক, মফিউদ্দৌলা, মহিউদ্দিন আহমদ, মোকলেছ, হাতেম আলী খান, ফজলুর রহমান, স্কুল ছাত্র মহিউদ্দিন, ছাত্রী জান্নাত আরা, সিংহজানী স্কুলের কাদের, কুদ্দুস ও রহমান, আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র আব্দুল আউয়াল, আব্দুর রহমান, রেজাউল করিম, আনোয়ার, বখতিয়ার হোসেন, রাজনৈতিক নেতা দেওয়ানপাড়ার মজিবর রহমান, আনিসুজ্জামান, সাহেদ আলী মিয়া, যমুনা, সৈয়দ আলী মন্ডল, আব্দুল গফুর, স্টেশন রোডের কুদ্দুস মল্লিক, কালু মিয়া, গেদা মিয়া, জবেদ, ছনকান্দার কালু, শাহপুরের সামাদ মন্ডল, ময়েন উদ্দিন ও যুবনেতা তিীশ তালুকদার। এ ছাড়া অধ্য এ.এইচ.এমএ. কুদ্দুস, অধ্যাপক শশাংক শেখর ভট্টাচার্য, ডা. মুনির উদ্দিন আহমেদ, কফিল উদ্দিন মোক্তার, সামসুজ্জোহা মোক্তার ও অধ্যাপক নুরুল হকসহ সচেতন শিক বুদ্ধিজীবী সমাজ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা করেন।

সেই বায়ান্ন

তৎকালীন জামালপুর মহকুমায় মূলতঃ ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মে থেকে প্রগতিশীল ছাত্র, সাহিত্য, সংস্কৃতি কর্মীদের মাঝে ভাষা চেতনার সূচনা হয়। ১৯৪৮ সালেই জামালপুর মহকুমার শেরপুর থানায় আনিছুর রহমানকে আহ্বায়ক করে “ভাষা কমিটি” নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান দিবসে শেরপুরের জিকে স্কুলে জমিদার রায় বাহাদুর সত্যেনের সভাপতিত্বে এক ছাত্র সমাবেশে স্কুল ছাত্র সৈয়দ আব্দুস সোবহান “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়” এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির পক্ষে কিছু বক্তব্য তুলে ধরলে তাকেসহ কয়েকজন ছাত্রকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে স্কুল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। গোড়া থেকেই ভাষা আন্দোলনে স্থানীয় সাহিত্যকর্মীদের প্রত্য ভূমিকা ছিল। “প্রতিবাদী দশক” ৫০ এ সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে গ্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী এ দুটি ধারায় বিভক্ত ছিল। ১৯৫১ সালে ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য চেতনার বাইরে “প্রবাহ সাহিত্য মজলিশ” নামে স্বদেশমুখী প্রগতিশীল একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে উঠে। সৈয়দ ইমামুর রশীদ, সৈয়দ আব্দুস সাত্তার, িিতশ তালুকদার, অরুন তালুকদার, আব্দুর রহমান সিদ্দিক, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম, রেবতীসহ প্রবাহ সাহিত্য মজলিশের সকলেই সক্রিয় ভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হায়দার আলী মল্লিককে সভাপতি ও তাছির উদ্দিন আহমেদ মোক্তারকে সেক্রেটারি করে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অবস্থান জামালপুরে শক্তিশালী ছিল। এছাড়া কমিউনিষ্ট নেতা আশুদত্ত, মনা দাশ ও চন্দন বোস সহ নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিষ্ট পার্টি ও কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা-কর্মী মুসলিম লীগের ছত্রচ্ছায়ায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে পড়ায় ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। ১৯৫১ সালের ফেব্র“য়ারীর শুরুতে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা তৈয়ব আলী আহমেদকে সভাপতি, আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক জহুরুল ইসলামকে সম্পাদক, আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগের তৎকালীন মহকুমা সভাপতি আক্তারুজ্জামান মতি ও আশেক মাহমুদ কলেজের মনোনীত জিএস সৈয়দ আব্দুস সোবহানকে যুগ্ম সম্পাদক করে জামালপুর মহকুমা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাশাপাশি আক্তারুজ্জামান মতিকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্নেই জামালপুরের সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। তখন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের অলিখিত অফিস ছিল এ্যাডভোকেট মৌলবী তৈয়ব আলী আহমেদের বকুলতলার চেম্বার যন্ত্রলেখা প্রেসের পাশে। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিয়মিত বসতেন তমালতলায় কমিউনিস্ট নেতা রমনীমোহন বাবুর অয় ফার্মেসী ও তৎকালীন রতন দেবী হল (পরে বিশ্বনাথ টকিজ, এন্তেজার হল) ও হিন্দি লাইব্রেরীতে (মার্চেন্ট একাডেমী)। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী প্রতিবাদ দিবস, ১১ ফেব্র“য়ারী পতাকা দিবস পালিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারাদেশে আহুত সাধারণ ধর্মঘট সফল করার ল্েয নেতারা সাইকেলে নকলা, ঝিনাইগাতি থানা সফর, স্কুল-কলেজে গণসংযোগ, ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধকরণ সভার পর ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। ২০ ফেব্র“য়ারী দিনব্যাপী জামালপুর শহরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মিছিল বের হয়। ইতিমধ্যে পুলিশ ছাত্র নেতা আক্তারুজ্জামান মতি, দিদারুল আরম খুররম, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, আলী আসাদ কালা খোকা, ফজলুল হক সাদা খোকা (পরে ওস্তাদ) সহ নেতৃত্বদানকারী ৮/১০ জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। হুলিয়া মাথায় নিয়েও নেতারা ছাত্রদের সংগঠিত করেন। প্রবল উত্তেজনায় পার হয় ২০ ও ২১ ফেব্র“য়ারী। ২১ ফেব্রুয়ারী সাধারণ ধর্মঘট আংশিক সফল হয় জামালপুর, সরিষাবাড়ী, ইসলামপুর, মেলান্দহ, শেরপুর, নকলা ও নালিতাবাড়ী থানায়। জামালপুরসহ উল্লিখিত থানাগুলোর প্রতিটি স্কুল-কলেজে পালিত হয় পূর্ণ ধর্মঘট। ছাত্ররা বেরিয়ে আসে রাস্তায়, প্রতিটি থানা সদরে ছাত্রদের মিছিলে শ্লোগান উঠে “ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। ২১ ফেব্রুয়ারী মেলান্দহে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ হামলা ও লাঠিচার্জ করে। পরে ছাত্র মিছিলে হামলার প্রতিবাদে সভা ও কিক্ষোভ মিছিল হয়। এখানে নেতৃত্বদেন ডাঃ মহসিন। সরিষাবাড়ীর আরডিএম পাইলট হাইস্কুলের ছাত্ররা ভাষা দাবিতে মিছিল করেন। ২১ ফেব্র“য়ারি সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে শহরে দোকান পাট, গাড়ি আংশিক বন্ধ থাকে। বিকেলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শহরে মিছিল হয়। মিছিলে গার্লস স্কুলের ছাত্রীরাও অংশ নেয়। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় গুলির সংবাদ জামালপুর পৌছলে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সার্বণিক অফিস হয়ে উঠে তৎকালীন রতন দেবী হলের পাশে হিন্দি লাইব্রেরী। ঢাকার পরিস্থিতি জানার পর গভীর রাত পর্যন্ত উত্তেজিত ছাত্র-জনতা সংগ্রাম পরিষদের অফিসে জমায়েত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারী সকাল থেকে জন্ম নেয় নতুন শ্লোগান “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-নূরুল আমিনের কল্লা চাই” দোকান পাট, অফিস, স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পুরো শহর হয়ে উঠে মিছিলের শহর। নান্দিনা, দিগপাইতসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে ছাত্র-জনতা কালোব্যাজ ধারণ করে শহরে আসতে থাকে। ঢাকায় গুলির প্রতিবাদে শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ডাকঘর ছাড়া শহরের সমস্ত অফিস আদালত বন্ধ থাকে। সকাল ১১টায় বকুলতলা থেকে মিছিল নিয়ে সরকারি বিদ্যালয়ে (বর্তমানে জিলা স্কুল) যাবার পথে পুলিশ ফাঁড়ির নিকট পুলিশ অফিসার খুরশিদ জাহান ছাত্রনেতা দিদারুল আলম খুররমকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার অবস্থায় দিদারুলকে মিছিলসহ নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এই স্কুলের ছাত্ররাও বেরিয়ে আসনে রাস্তায়, মিছিলে। ২২ ফেব্রুয়ারী সারা শহর ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে জামালপুর শহর। মোড়ে মোড়ে হয় পথ সভা। নেতারা টিনের চোঙ্গা দিয়ে বক্তব্য রাখেন। ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলির প্রতিবাদে ওইদিন বিকেলে হিন্দু বোর্ডিং মাঠে (বর্তমানে হাইস্কুল) ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশ হয়। এখানে তৈয়ব আলী আহমেদ, তাছির উদ্দিন মোক্তার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এখান থেকে মিছিল সহ ছাত্র-জনতা রেল স্টেশন ময়দানে গিয়ে বিশাল জনসভায় যোগ দেন। রেলস্টেশন ময়দানে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বিশাল সমাবেশে ঢাকায় গুলি, ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ করে নিহতদের পরিবারবর্গকে তিপূরণ প্রদান, মুসলিম লীগ মন্ত্রী সভা ও এমএলএ দের পদত্যাগ ও ছাত্র বন্দিদের মুক্তিসহ বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্ত—ানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি এবং ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
২২ ফেব্রুয়ারী শুধু জামালপুর শহর নয়, সরিষাবাড়ী, মেলান্দহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ থানায় ব্যাপক মিছিল সমাবেশ হয়। ২২ ফেব্র“য়ারি জামালপুর শহর সহ সবকটি থানায় স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সফল হয় সর্বাত্মক ধর্মঘট কর্মসূচি। সেদিন রাতেই পুলিশ গ্রেফতার করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা আক্তারুজ্জামান মতি, আলী আসাদ কালা খোকা, ফজলুল হক সাদা খোকাসহ ৮ নেতাকে। খুররমসহ গ্রেফতারকৃতদের ৭ দিন জামালপুর সাব জেলে রাখার পর ১ মাসের আটকাদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়মনসিংহ জেলে। জেলে ভাষা সৈনিকদের নিয়মিত খোঁজ খবর নিতেন প্রাক্তন মন্ত্রী সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ। ২৩ ফেব্রুয়ারী মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে চলমান ভাষা সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষে স্থানীয় হিন্দি লাইব্রেরীতে স্কুল-কলেজের ছাত্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের একসভায় ৫৫ সদস্যের মহকুমা শাখা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন একটি কমিটি গঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থাকা সত্ত্বেও নতুন এই কমিটি গঠন বিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় ফেব্র“য়ারির প্রথম দিকে গঠিত কমিটি ছিল মুলতঃ রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতাকর্মীদের নিয়ে। পরবর্তী সময় আন্দোলনের তীব্রতা ও ঢাকায় ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্দোলনকে আরো বেগবান করার স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ও সংস্কৃতি কর্মীদের নিয়ে এই নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ৫ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট সফল করার ল্েয ২৫ ফেব্রুয়ারী জামালপুরে আহ্বান করা হয়। ছাত্র-জনতা জমায়েত। নেতারা বেরিয়ে পড়েন থানা সফরে। থানা গুলোতে ব্যাপক জনসংযোগ, সভা ও শোভাযাত্রা হয়। প্রতিটি শোভাযাত্রায় সকলে কালোব্যাজ ধারণ করতেন। ২৩ ফেব্রুয়ারী কেন্দুয়া কালিবাড়ীতে ভাষার দাবিতে জনসভা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারী সরিষাবাড়ীর পিংনা হাইস্কুল মাঠে হাতেম আলী খানের সভাপতিত্বে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার বিরাট সমাবেশ হয়। সমাবেশে অধ্যাপক সুজায়াত আলী, সৈয়দ আব্দুস সোবহান ছাড়াও জেলা নেতারা বক্তব্য রাখেন। ঐদিন আর ডিএম হাইস্কুল প্রাঙ্গণেও এক বিরাট সভা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারী মেলান্দহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ সহ বিভিন্ন থানায় ছাত্র-জনসভা ও শোভাযাত্রা বের হয়। ২১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারী সরিষাবাড়িতে পালিত হয় হরতাল। অন্যান্য থানায়ও ধর্মঘট পালিত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারী জামালপুর শহরে ধর্মঘট ডাকা হয়। এ ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল হয়। ধর্মঘট থাকায় বিভিন্ন থানা থেকে ছাত্র-জনতা পায়ে হেঁটে ও সাইকেলে করে এসে পূর্ব ঘোষিত সমাবেশে যোগ দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারী গোপালদত্তের মাঠ ও হিন্দু বোর্ডিং মাঠে বিশাল সমাবেশ হয়। সেদিন শহর হয়ে উঠে মিছিলের শহর। দিনব্যাপী শহরে খন্ড খন্ড মিছিল হয়। এ দিন স্কুল ছাত্রীরাও বেরিয়ে আসেন রাস্তায়, পিকেটিংয়ে অংশ নেন। বিুব্ধ জনতা সেদিন ডেপুটি সিভিল সার্জন অফিস, সমাজ কল্যাণ দফতর ও মহকুমা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও করে রাখে। মহকুমা প্রশাসক হাসান কবির জনতার প্রতিরোধের মুখে সেদিন অফিসে যেতে পারেননি। কোন অফিসার কর্মচারীই সেদিন অফিসে যাননি। এদিন ছাত্ররা এমএলএ আলী আহমেদ কালা মৌলভীকে ধাওয়া করলে তিনি দৌড়ে পালান। এদিন কলেজ ও স্কুলের শিকরাও রাস্তায় নামেন। ২৭ ফেব্র“য়ারি নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুনের পিতা অধ্য এ.এইচ.এস কুদ্দুসের সভাপতিত্বে জামালপুর কলেজ টিচার্স কাউন্সিলের এক সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারী নান্দিনায় সিরাজুল হকের সভাপতিত্বে প্রায় ৩ হাজার মানুষের সভায় ঢাকায় গুলিবর্ষনে নিন্দা ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি জানানো হয়। ১ মার্চ দেওয়ানগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে নাদের হোসেনের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়। ৩ মার্চ পর্যন্ত জামালপুর শহর ও থানা গুলোতে ভাষার দাবিতে প্রতিদিন সভা, সমাবেশ ও মিছিল হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৩ মার্চ “কৃষ্ণ দিবস” এ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে জামালপুর সদরসহ সবকটি থানায় পূর্ণ দিবস ধর্মঘট পালিত হয়। ৫ মার্চ সিংহজানি মসজিদের সামনে তৈয়ব আলীর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি সভা হয়। ৫ মার্চ পালিত হয় সর্বাত্মক ধর্মঘট। এছাড়াও ১১ মার্চ মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগ ও কলেজ ইউনিয়নের (ছাত্র সংসদ) উদ্যোগে স্কুল কলেজে ধর্মঘট ও মিছিল হয়। ১২ মার্চ গোপাল দত্তের মাঠে ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে জনসভা হয়।